কবিতার মাধ্যমে শ্রীজাতর অন্যতম ছবি ‘মানবজমিন’, অভিনয়ে দর্শকদের মন জয় করলো পরান বন্দ্যোপাধ্যায়!
সম্ভবত কয়েকদিন আগেই শ্রীজাত বলেছিলেন, আমি বিদ্বজন নই, কলমজীবি।” কলমজীবি শ্রীজাত ইচ্ছে করলে সিনেমাজীবি হতেই পারেন এ কথা তিনি আচ্ছা মতন বুঝিয়ে দিলেন।
তাঁর প্রথম নিবেদন “মানবজমিন” বক্তব্যের গভীরতায়,জীবনধর্মী ভাবনায় তো বটেই, সিনেমার ভাষাকেও কবিতা এবং সাহিত্যের অলঙ্কারে সাজিয়ে তুলতে বেশ যত্নবানই নয়, বেশ পরিপাটি, স্নিগ্ধ, মনোরম, মনোগ্রাহী এবং সবার ওপরে “বই” নয়, শ্রীজাত ‘মানবজমিন’ সিনেমাই হয়ে উঠেছে।
আসলে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নাম “মানবজমিন।” অনাথ এবং গরীব ছেলেমেয়েদের জন্য একটা স্কুল তৈরি করতে চায় ব্যাংক কর্মী সংকেত (পরমব্রত) আর তার প্রেমিকা কুহু (প্রিয়াঙ্কা)। সরকারি অনুদানে জমি পেয়েছে। অর্থ দরকার স্কুলবিল্ডিং তৈরি করার জন্য । সেটা প্রায় হঠাৎই পেতে পেতেও হাত ছাড়া হয়ে গেলে হতাশ হয় দুজনেই। সংকেতের পয়সাওয়ালা জ্যাঠা বরেনবাবুর(পরাণ) মধ্যে একটা আলোর দেখা মেলে। তিনি ব্যবসা বাণিজ্য করে রীতিমত অর্থ বান! এইকালে দাঁড়িয়ে তিনি পরকালের কথা ভাবেন, সারাক্ষণ পরিকল্পনা করেন । তিনি আবার বাংলা সিনেমার দুঁদে অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের অন্ধভক্ত। তাঁর ছবি রয়েছে ঘরের দেওয়াল জুড়ে, ঠাকুরের বদলে ছবি বিশ্বাসের ছবিকেই তিনি ধূপ দীপ জ্বালিয়ে পুজো করেন। রাস্তার কুকুর বেড়ালদের খাবার বিলি করেন স্বর্গে ঠাঁই পাবার জন্য । কিন্তু “মানবজমিন” এর স্কুলের জন্য আর্থিক সাহায্যে তিনি কোনোভাবে রাজি নন।
এবার নির্মিয়মাণ বাড়ির জন্য কীভাবে স্বর্গলোভি জ্যাঠার কাছ থেকে সংকেত ও কুহু পঁচাত্তর লাখ টাকা আদায় করে – সেটাই দর্শককে হাসি, মজা,রহস্য আর নাটকের ব্যবহারে শ্রীজাত উপস্থিত করেছেন দর্শকের ভালো লাগানোর কথা ভেবেই! গল্পে ঢুকে পড়েছেন স্বর্গে রিয়েল এস্টেট “আকাশ প্রদীপ” এর দুই দালাল জীবন ও বিজন। এবং সেই এস্টেটের প্রচার করতে এসে যান স্বয়ং পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় স্বনামেই! এগুলো চমক ঠিকই, কিন্তু মিষ্টি চমক!
শুধু হাসি মজায় মাখানো নয় শ্রীজাতর চিত্রনাট্য, গানে কবিতায় নান্দনিক সৃজনে সিনেমার ভাষায় সম্পৃক্ত। নিজের কবিতার সাথে সাথে ছবির শেষ পর্বে শঙ্খ ঘোষের কবিতাও সুন্দর ভাবে ব্যবহার করেছে। “তুমি সুখী হলে দুঃখ হারিয়ে যায়….” গানটিতো বটেই, এমনকী, প্রচলিত রামপ্রসাদী গান “মনরে কৃষি কাজ জানো না..” কেও সুচারু কৌশলে ব্যবহার করেছেন। সংলাপের মধ্যেও রয়েছে হাস্যরস, ব্যঙ্গ, কিছুটা বিদ্রুপের আভাসও। সংকেত – কুহুর চুম্বনের দৃশ্য দিয়ে শুরু ছবি এবং ছবি শেষও হবে তাদের দুজনের চুম্বন দৃশ্যের মাধ্যমে। কিন্তু, এই ছবি তো নিছক কমেডি নয়,তাই ফিরে আসে রবীন্দ্রনাথের কবিতা “অমল ধবল পালে….” । দর্শককে এক স্নিগ্ধ অনুভূতি ও নান্দনিক প্রাপ্তি ভরিয়ে দেয়। বাণিজ্যকে অস্বীকার করে নয়, “মানবজীবন” ছবি শিল্প ও বাণিজ্যের এক সুষম সহবস্থান। বরেনবাবুর হৃদরোগের পর হৃদয় পরিবর্তনের পর্বটি সেই অবস্থানের ব্যাপারটি স্পষ্ট করে। রূপঙ্কর এর গাওয়া গানটি কাজ করে একটি সুন্দর আলপনার! এগুলোই এই ছবির সৌন্দর্য্য!
তার সাথে বলতেই হবে অভিনয়ের কথা। দর্শকের মন জয় করতে কোন রকম ত্রুটি রাখেন নি পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, খরাজ মুখোপাধ্যায়, পরমব্রত ও প্রিয়াঙ্কা। বাড়তি নম্বর বরাদ্দ পরাণদার। তবে একটাই কিঞ্চিৎ আফসোস রয়েই গেলো বিভিন্ন দৃশ্যে আবহে অপ্রয়োজনীয় বাজনার ব্যবহার, এদিকে একটু নজর দেওয়া উচিত ছিল।