এখনো বাড়ির বাকিদের সঙ্গে নামের ফলকে নামটা জ্বলজ্বল করছে “ঐন্দ্রিলা শর্মা।” বহরমপুরে সেই তিন তলা সাদা বাড়িটায় রবিবারে শুধুই নিস্তব্ধতা। সেই প্রাণবন্ত হাসি,সেই চিৎকার আর নেই। তার কোনদিনও শোনাও যাবেনা। বাড়িটা ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারে। রীতিমতো স্মৃতিকে ধরে আখড়াচ্ছে অরবিন্দ কাকু ও শিপ্রা কাকিমা।
বহরমপুর মোহনা বাস স্ট্যান্ড থেকে রানিবাগান মোড় হয়ে ইন্দ্রপ্রস্থের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এটিএমের পাশের গলি। আর সেখানেই রয়েছে তাদের সাদা তিন তলা বাড়িটা।লোহার পলক এর উপর লেখা তার নাম।তাতে লেখা উত্তম শর্মা, ঐশ্বর্য শর্মা, শিখা শর্মা, ঐন্দ্রিলা শর্মা। সব শেষ নামটা এ বাড়ির ছোট মেয়ের। তার ছোটবেলা কেটেছে এই বাড়িতেই দীর্ঘ রোগভোগের পথ পেরিয়ে রবিবারে দুপুরে সে চিরশান্তির পথে পাড়ি দিয়েছেন। রবিবারের দুপুরে ঐন্দ্রিলা দিদি ঐশ্বর্যা পাড়ায় কয়েকজনকে মৃত্যু সংবাদ টা দেন। বলেন, ‘‘বোনকে আর ফেরাতে পারলাম না গো!’’ দুপুর ১টা ৪৫মিনিট নাগাদ ফোনটা আসে দীর্ঘ দিনের প্রতিবেশী শিপ্রা কাকিমার কাছে। ঐশ্বর্যা ফোনে বলেন, ‘‘মিষ্টি আর নেই !’’ মুহূর্তের মধ্যে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে সারা পাড়ায়। তারপরই আস্তে আস্তে ভীড় জমতে থাকে সাদা বাড়ির সামনে।
খবর পাওয়া মাত্রই তার দীর্ঘদিনের নাচের শিক্ষক অভিজ্ঞান ভট্টাচার্যী ছুটে আসেন তার বাড়ির সামনে।বলেন, ‘‘পুজোর আগে দুর্গে দুর্গতিনাশিনী গানে আমরা একটা মিউজিক ভিডিয়ো করেছিলাম। মিষ্টির সেই পারফরম্যান্সটা আজও মনে পড়ে। পেশাদারি অভিনয় শুরুর পরেও কলকাতা থেকে এতটা পথ পেরিয়ে বহরমপুরে পৌঁছেই আবার রিহার্সালে চলে আসত।’’
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন এই অভিনেত্রী ঐ ঐন্দ্রিলা শর্মা। ছোটবেলায় যার কাছে আকার হাতে খড়ি, সেই প্রসেনজিৎ জানালেন,”ওকে নিজের মতো আঁকতে দিলে সব অদ্ভুত ছবি এঁকে দিত! এক জন আর্টিস্টের যা যা গুণ থাকা প্রয়োজন, ঈশ্বর তাঁকে ঢেলে দিয়েছিলেন।” ঐন্দ্রিলার সঙ্গে তার একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বহরমপুর এনে অভিনেত্রী তার বাড়িতে অবশ্যই আসতেন। প্রসেনজিৎ বললেন,”একটি রিয়েলিটি শোতে প্রথম হয়েই ওঁর কাকিমাকে ফোন করেছিল। বলেছিল, বাড়ি গিয়ে কিন্তু তোমার হাতের চিকেন পকোড়া খাব। এই তো পুজোর মধ্যে এসেও কত গল্প করে গেল, বয়াম থেকে নিজের হাতে তুলে নাড়ু খেল।”
ঐন্দ্রিলাদের দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। বলেন, ‘‘২০১১ সাল থেকে আমি ওদের প্রতিবেশী। মিষ্টি বাড়ি আছে কি না কাউকে জিজ্ঞেস করতে হত না, অট্টহাসি আর চিল চিৎকার বলে দিত মিষ্টি এসে গেছে। এ রকম প্রাণোচ্ছ্বল, সদা-হাস্য একটি মেয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেল ভাবতেই পারছি না।”
বহরমপুর এলে অরবিন্দু কাকুর দোকান থেকে কেক খেতে তিনি ছুটে যেতেন। তিনি নিজেই জানালেন। বললেন,”কেক বড্ড প্রিয় ছিল ঐন্দ্রিলার, বাড়ি এলেই রানিবাগান মোড়ের দোকান থেকে তার কেক নেওয়া চাই চাই!” অরবিন্দু মৃত্যু সংবাদ পেয়েছেন এই সংবাদ মাধ্যম থেকেই।তাঁর কথায়, ‘‘যতবার বাড়ি আসত, আমার দোকান থেকে কেক নেবেই নেবে! ও নিজে এত অসুস্থ, তবুও কেক কেনার পর জিজ্ঞেস করত, কাকু, শরীর ভাল আছে? কেক নিতে হয়ত অনেকেই আসবেন, কেউ আর এ ভাবে কখনও জানতে চাইবে না, ভাল আছি কি না!”